অদ্ভুত মনস্তাত্বিক টানাপোড়েনের এই গল্প কখনো দিদি-ভাই কখনো বা নারী-পুরুষের চাওয়া-পাওয়ায় দোদুল্যমান। লেখিকার কলমের মুন্সিয়ানায় এই লেখা যেন অবিরত ভেসে চলে, মাটি ছোঁয় না। আগাগোড়া ক্লাসিক ধাঁচে লেখা আবহমান এক রূপকথা।
Show/hide complete review
অনেকদিন বাদে একটা তীব্র মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস পড়লাম। "সাগরবেলায় ঘর" - পুরো উপন্যাসটাই লেখা হয়েছে শ্রুতি ও সায়নের ব্যক্তিগত দিনলিপির আঙ্গিকে। দুই অসমবয়সী প্রেমীর রূপকথা। যেখানে মেয়েটি ছেলেটির থেকে সাতবছরের বড়। ছেলেটার 'প্রায় ভাই-ভাই' ভাব আর মেয়েটির 'প্রায় দিদিসুলভ' আচরণের মধ্য গড়ে ওঠে অব্যক্ত এক ভালোবাসা।
দিনলিপির আদলে এক অদ্ভুত মজা থাকে। যেখানে ডায়রিতে লেখা কথা একান্ত নিজস্ব, কিন্তু পাঠকের কাছে পুরোটাই উন্মুক্ত। যেন নাটকের মঞ্চকুশীলবদের ফিসফিস করে কথা বলা। যা শুনতে পায় প্রেক্ষাগৃহের পিছনের শেষ সারিতে বসা দর্শকরাও।
অদ্ভুত মনস্তাত্বিক টানাপোড়েনের এই গল্প কখনো দিদি-ভাই কখনো বা নারী-পুরুষের চাওয়া-পাওয়ায় দোদুল্যমান।
লেখিকার লেখার মুন্সিয়ানায় এই লেখা যেন অবিরত ভেসে চলে, মাটি ছোঁয় না। ভালোবাসার এই কাহিনিতে কোনো তাড়াহুড়ো নেই। নেই কাহিনিতে মোচড় এনে পাঠককে চমকে দেওয়ার কোনো অভিপ্রায়। আগাগোড়া ক্লাসিক ধাঁচে লেখা আবহমান এক রূপকথা। ঠিক যেন, যেমন ছিল...তেমন আছে...এমনই চলবে। কুলুকুলু শব্দে বয়ে যাওয়া নদীর মতো। শান্ত, গতিময় কিন্তু সম্পর্কের চোরাস্রোত মাঝেমাঝেই এলোমেলো করে দেয় দুজনকেই। লেখিকা সেই দোলাচলকে নিখুঁতভাবে বুনেছেন পাতায় পাতায়। ভীষণভাবে দমবন্ধকরা, দুঃসাহসিক!
কাহিনিতে অন্যান্য চরিত্ররা অতি স্বাভাবিকভাবে এসেছে ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, অথবা শ্রুতি-সায়নের স্মৃতিতে। লেখিকা তাদের আলাদা করে পাঠককে চিনিয়ে চেষ্টা করেননি। কারণটা স্বাভাবিক। শ্রুতি বা সায়ন ডায়রি লিখছে, নিজের কথা লিখছে। সেখানে সব চরিত্ররা তাদের নিজেদের চেনা মানুষ। এই কারণেই উপন্যাস এক অন্যমাত্রায় পৌঁছে যায়। শ্রুতি বা সায়ন, কার ডায়রির পাতা পাঠক পড়ছে সেটা বুঝে নিতে হয় দিনলিপির শুরুতে থাকা অলংকরণ দেখে। এখানেও লেখিকার ভাবনার কৌশলী প্রয়োগ প্রশংসার দাবী রাখে।
সায়নের ডায়রি লেখা হালকা, আপাত অগভীর, মজাদার। অন্যদিকে শ্রুতির ভাষায় অনন্য শব্দবন্ধ চমকে দেয়। গম্ভীর পুরনো আর হালকা নতুন শব্দের ব্যবহার মনের অন্তস্তলকে নাড়া দেয়।
শুরুতেই বলেছি, বহমান এই উপন্যাসের পরিণতি নেই। গল্প ভাসতে ভাসতে একসময় পাঠককে অনেক প্রশ্নের মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে হঠাৎ শেষ হয়ে যায়।
শেষ কিছু পৃষ্ঠায় শ্রুতি-সায়ন তাদের দিনলিপিতে রাজকন্যা-রাজপুত্র থেকে বাস্তবের সাধারণ নারী-পুরুষ হয়ে গেল। কিছুটা স্বপ্নভঙ্গ হলেও জীবন এমনিই তো হয়! তবুও মনে হচ্ছে, শেষ কি আরো একটু শক্তিশালী হতে পারত না? নাকি লেখিকা সেটাই চেয়েছেন? হন্ট করছে...
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার উপন্যাস এটা নয়, আমার মতে। ভারি জটিল, টালমাটাল, টানাপোড়েন...
লেখিকাকে কুর্ণিশ। এমন একটি ক্লাসিক উপহার দেবার জন্য। এমন সোনার কলম বাংলা সাহিত্যকে ধন্য করুক।
অনেকদিন উপন্যাস পড়া ছেড়ে দিয়েছিলাম। ক্রমাগত থোড় বড়িখাড়া... ইত্যাদি পড়তে পড়তে বীতশ্রদ্ধ হয়ে। নতুন করে আবার বাংলা উপন্যাস পড়ার ইচ্ছা জাগালো এই লেখা। মনের মধ্যে চিরদিনের জন্য অন্তরীন হয়ে রইল কিছু ভালো লাগা।
পুনশ্চ- সায়ন বাঁহাতি আর শ্রুতি ডানহাতি, এটা শুধু বোঝা গেছে অলংকরণে। উপন্যাসে কোথাও উল্লেখ নেই। 🙂
শুভেচ্ছাসহ,
অক্ষয় দাস